১৯১৪ সাল।
বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেছে। আমেরিকায় কানেকটিকাটে জন্ম হল জন অ্যালাইন স্মিথ নামে একটি
শিশুর যে সেই থেকে ছিল দুর্ভাগ্য পীড়িত। ছোটবেলা থেকেই নার্ভাস আর শেকি ছিল সে। তার ওপর অর্থাভাবে কিনা তার ব্যাঙ্কার বাবা, জনের ১২ বছর তখন, নিজেকে গুলি মেরে
আত্মহত্যা করলে মা দ্বিতীয় বিবাহ করে অন্যত্র চলে যায়। জনও সেই সঙ্গে। কিন্তু বাবার
আত্মহত্যা দুঃস্বপ্নের মতো তার পেছনে লেগে থাকল। সেই মৃত্যু গভীর দাগ কেটে যায় তার মনে যা থেকে মুক্তি
পাননি আজীবন। তারপর সৎপিতার নামানুসারে জন বেরিম্যান হয়ে
যান তিনি। স্কুল থেকে বেরিয়ে ১৭ বছর বয়সে নিজেও একবার আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা
করেন। এরপর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মেন্টর কবি মার্ক ভ্যান ডোরেন তাকে
কবিতা লিখতে উৎসাহিত করেন। জনের কবিতা ক্রমে
বিকশিত হতে থাকে। লোকে বলতে শুরু করে ইয়েটস-এর মতো হচ্ছে। তিনি বলেন “ইয়েটস-এর মতো
না, ইয়েটসই হতে চাই।“ এরপর কেম্ব্রিজে পড়াশুনো করে ফিরে এসে কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। নার্ভ বরাবর
দুর্বল ছিল। ২৪ বছর বয়সে হাসপাতালে ভর্তি হন মৃগিরোগের জন্য। তিনবার বিয়ে করে অসফল
হন। বাবার দুঃস্মৃতি তাকে
ছাড়ে না কিছুতেই। অবশেষে ১৯৭২ সালে ওয়াশিংটন এভিনিউ ব্রিজ থেকে মিসিসিপি নদীতে
ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন কবি জন বেরিম্যান। কবিদের জীবন এমনই হয় ?
আমেরিকায় ৫০/৬০ দশকে শুরু হয় কনফেশনাল
পোয়েট্রি আন্দোলন ( স্বীকারোক্তি কবিতা)। বেরিম্যান ছিলেন তার অন্যতম পুরোধা। অন্য
সঙ্গীরা ছিলেন রবার্ট লোয়েল, সিলভিয়া প্ল্যাথ, অ্যানি সেক্সটন, অ্যালেন
গিন্সবার্গ, ডব্লিউ- ডি- স্নডগ্রাস, ইত্যাদিরা। আমাদের সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় ৬০ দশকে কিছুকাল আমেরিকায় থেকে ফিরে এসে বাংলায় ‘স্বীকারোক্তি কবিতা’
প্রথম লেখেন – “আমি কিরকমভাবে বেঁচে আছি”। জীবিতাবস্থাতেই বেরিম্যানের অনেকগুলো বই
প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা হয় তার “ড্রিম সঙ্গস্” (স্বপ্ন গানেরা)
নামের বইটি। বাবার স্মৃতি নানাভাবে প্রবেশ করে স্বপ্নিল কবিতায়। ‘হেনরি’ নামের এক অলীক
প্রতিভুকে সামনে রেখে প্রথম, দ্বিতিয়, তৃতীয় পুরুষে স্বগতোক্তি করে চলেন যাতে
কবিতার অদ্ভুত রহস্য তৈরি হয়। লোয়েল মন্তব্য করেন – At first the
brain aches and freezes at so much darkness, disorder and oddness. After a
while the repeated situations and their racy jibber becomes more and more
enjoyable. এর জবাবে বেরিম্যান বলেন – These poems are not
meant to be understood. They are only meant to terrify and comfort.
অনেক পুরস্কার পেয়েছেন
বেরিম্যান। কবিতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কার, বলিঞ্জেন পুরস্কার, জাতীয় পুস্তকের জন্য
পুরস্কার, এমনকি নুস্ত্যাট আন্তর্জাতিক কবিতা পুরস্কারের জন্যও সুপারিশ করা হয়েছিল
তার নাম। রহস্যের জন্যই বারে বারে পড়তে ভাল লাগে জন বেরিম্যানের কবিতা। ‘বাক’-এর
পাঠকেরও ভাল লাগবে এই আশায় ৩২৮টি “স্বপ্ন গান” থেকে চারটে কবিতার অনুবাদ সাজিয়ে
দিয়েছেন বারীন ঘোষাল। বেরিম্যান কারও মত লেখেননি, কেউ তার মত লেখেননি, ব্যাপারটা
অদ্ভুত, না ? পড়ুন ----
স্বপ্ন গান – ১
অভিমানে হেনরি তো লুকিয়েছিল সেদিন।
না-শান্ত হেনরির গোমড়ামুখ আজ,
আমি তার পয়েন্টটা বুঝেছি এই যে সব কিছু
উল্টে দিতে চাওয়ার
এমন ভাবনা যে, ওরা ভেবেছিল ওরাই সেরে
ফেলবে সবটা আর
তাতেই বদমেজাজি হেনরি কেটে পড়েছিল,
কিন্তু
তার উচিত ছিল মুখের ওপর শুনিয়ে দেওয়া,
হ্যাঁ ।
গোটা পৃথিবীটাই ছিল যেন এক পশম প্রেমিকা
হেনরির পাশেই আছে বলে মনে হতো সেদিন।
তবু কেন ছাড়াছাড়ি হল। তারপর কিছুই হল না যা ছিল
সম্ভব আর উচিতও ছিল ঘটে যাওয়া। বুঝি না কি ভাবে
সবার দৃষ্টির সামনেই আড়ালে আবডালে থেকেও
এসব তারিয়ে দেখল আর ধরাও পড়ল না সে।
এখনো বলার তার বাকি বড় বিস্ময়ের কথা
পৃথিবী যার সবটাই বহন করে চলে যাবে দূরে।
একবার একটা ডুমুর গাছের মাথায় চড়ে
খোশ মেজাজে গান ধরেছিলাম আমি। দেখি
জমিনকে আঁটো করে পরেছে সাগর আর
শূন্যরা গড়ে উঠে প্রতি বিছানায় -- সেই
সব।
--------
স্বপ্ন গান – ২৯
সেখানে সে বসেছিল, একবার, একটু কি
হেনরির মনে পড়ে
এত ভারী, সে যদি সহস্র বছর পেতো, আরো
একটু বেশি বা
কান্নায়, নির্ঘুমে, এবং তার সমস্ত সময়ে
হেনরি কিছুই করে উঠতে পারলো না
হেনরির কানে কানে সেই থেকে শুরু হয়েছিল
হালকা কাশির গন্ধ, রুনুঝুনু, একটু নাড়ী
নারীবেগ।
আরো একটা ব্যাপার আছে তার মনে যেটা
গ্রামের কবরচিত্রের মতো হাজার বছর অমলিন
যে দাগের কলঙ্ক রেখা কখনো মোছে না,
খোলা চোখে, সে লক্ষ্য রাখে, অন্ধ সেজে।
ঘন্টার শব্দগুলো বলে চলে – দেরি হয়ে
গেছে
এই অশ্রু পতনের কী নয় – ভাবছে তখনো।
কিন্তু হেনরি কখনো করেনি, শুধু ভেবেছিল যে
সে-ই করেছে,
শেষ করে, কুচিকুচি করা হয়েছিল মেয়েটাকে
আর টুকরোগুলো লুকিয়ে রাখা, যেখানে স্পষ্ট
দেখা যায়
সে জানে – সবাইকে সে খুঁজেছিল যারা হারায়নি
কখনো।
প্রায়ই তার মনে হয়, ভোরে, সবাই ফিরেছে
হারিয়ে এভাবে কেউ যায় না তো।
----------
স্বপ্ন গান – ৪৫
সর্বনাশের দিকে চেয়ে আছে। নাশও তারই
দিকে ফেরা।
ভেবেছিল তারা পুরনো বন্ধু। সিড়িতেই টের পেল,
যেখানে মেয়েটার বাবা তাদের উলঙ্গ অবস্থায়
দেখেছিল,
ঘনিষ্ঠ হয়ে ছিল তারা। দোস্তির গোপন কথার
চিরকুট
যেদিন হারিয়ে গেল, ভেবেছিল খুব ভেবেছিল,
ঝোঁক তার
নাশের, তাদের পথ আড়াআড়ি আঁকা
এবং একবারই পরস্পর এড়িয়ে গিয়েছিল জেলে;
বিছানাতেও;
আর নিস্বাক্ষর চিঠিতে দেখা হয়েছিল তাদের
চোখের ,
কোন এক এশিয়ার আশ্চর্য শহরে, অনির্দেশ
আর ইতস্তত, এই দুটো আর তিনটের মধ্যে
অথবা একটা টেলিফোনের আশংকায় চমকিত
ঠিক যখন তার মাথায় কেউ তার জড়িয়েছে
একটা ভুল ধারণায় পৌঁছতে, মৃগ থেকে
‘মৃগি’।
অথচ সে যখন টের পেল -- তারা পুরনো বন্ধু
নয়,
এটা তার জানা ছিল। না।
এই তো অচেনা একজন, শুধরে দিতে এসেছে
সমস্ত ভন্ডামি, আর সেটাই জারি করতে।
হেনরি রাজি হল। না -- ।
------------
স্বপ্ন গান – ৩৮২
হেনরির শবযান থেকে কিছু একটা ভাল ভাবে পড়ে
যাক নিচে
এর বেশি বোঝাতে আর কেউ যেওনা সেখানে
প্রাচীন চারণ গান হচ্ছে কোথাও, ক্রমশ
স্বরানো
বিষন্ন, তবে শোকটা কমানো যেন
নির্দোষ ঠাট্টায়, অথচ সবারই মেজাজ প্রায়
কমানো, নামানো
যতক্ষণ নাচিয়ে না এল, ছোট খাটো পোষাক
গায়ে
কালো চুল, লম্বা আর খোলা, কালো মালো
চশমায়
মুখটা ওঁচানো,
ফ্যাকাশে, আর হঠাৎই গানটা বদলে গেল
‘দাও!’ আর ‘ওয়াও!’ এবং হাও হাও; গান
পালটে যাচ্ছে
পিছনের পা পিছনে ছুঁড়ছে মেয়েটা
পাটিপিয়া আঙুলের ভরে নাচছে মেয়েটা
সাবলীল
সঙ্গীতের গীতার্ত-গীতল ধাক্কায় ভাসে,
নামে, আর হঠাৎই
ফিরে যায় সেই ভয়ানক লোকটার কাছে
অবস্থাটা অসম্ভব পাগলপনা, মেয়েটি হাত
নাড়ে, নরকের দিকে
মেয়েটি পা ছোঁড়ে মাথার ওপর, ঝাঁকুনি
দেয়, সব ঠিকঠাক,
মেয়েটি হেনরিকে নেচে নিয়ে যায়