শতাব্দী উত্তরণের কালচিহ্ন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়ে
থাকে, যেমন বিজ্ঞানে দর্শনে রাজনীতি গণচেতনায়, তেমনিই সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্প সিনেমায়। মিলেনিয়ামের
সময় সমীক্ষা শুরু হয়ে যায়। জেমস জয়েস যেমন গদ্য রচনায় চেতনাপ্রবাহের সৃষ্টি করেন, প্রায় একই সময়ে থমাস
আর্ণেস্ট হিউম কবিতায় চিত্রকল্পের অবতারণা করেন, যতটা না কাজে তার চেয়ে বেশি ভাবনা প্রকাশে।
কী ব্যাপার সেটা আর লোকটাই বা কে একটু দেখে নেয়া যাক। আপনারা সবাই নিশ্চয়ই বেকহ্যাম
বা রনির নাম শুনেছেন, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ফুটবলার, কিন্তু কতজন জর্জ বেস্ট-এর নাম শুনেছেন বলুন
তো ? জর্জ বেস্ট ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা প্লেয়ার হওয়া সত্বেও দেশের হয়ে খেলতে পারেননি
কেবল চরিত্রদোষে। আপনারা সবাই এলিয়ট বা পাউন্ডের নাম শুনেছেন, কিন্তু তাদের কবিতায়
দীর্ঘ প্রভাব ছিল হিউমের, সেটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। কবিতায় ইমেজিস্ট আন্দোলন শুরু করেন
তিনি। তারপর একে একে রোমান্টিসিজম, নিউ মডার্নিজম নিয়ে ভাবনাগুলো প্রকাশ এবং
কবিতায় তার প্রয়োগ করা শুরু করেছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন তার্কিক, দার্শনিক, প্রবক্তা, এবং সর্বশেষে একজন
কবি। জীবদ্দশায় তার কোন বই প্রকাশিত হয়নি, তাঁর আগ্রহ ছিল না। মৃত্যুর পরে তাঁর কবিতা
ও প্রবন্ধের বইগুলো প্রকাশিত হয়, তাঁর ওপর অনেকে প্রবন্ধ লেখেন, বিশেষ করে এজরা পাউন্ড
ও টি-এস-এলিয়ট। তাতে হিউমের ইমেজ তাদের থেকে বড় হবার উপক্রম হলে তারা গুটিয়ে যান, এমনকি কেউ কেউ অস্বীকারও
করেছেন পরে।
টি-ই-হিউম, জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডে
১৮৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে। মারা যান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে ১৯১৭ সালে মাত্র
৩৪ বছর বয়সে। ছেলেবেলায় আগবাড়া মারকুটে টাইপের এবং চূড়ান্ত তার্কিক ছিলেন। কেম্ব্রিজ
কলেজ থেকে দুবার বিতাড়িত হন, একবার বাইচ প্রতিযোগিতায় মারপিটের জন্য, আর একবার পথমাগীদের
নিয়ে ফস্টিনষ্টির ক্যাঁচালে। পড়াশুনোর জন্য চলে যান কানাডা। সেখান থেকে ব্রাসেলস-এ।
ব্রাসেলসে দর্শনশাস্ত্রের ওপর, বিশেষ করে অঁরি বার্গসঁ'র দর্শন ভাবনায় আগ্রহী হয়ে প্রবন্ধ লেখা শুরু
করেন। এরপর ইমেজিস্ট চিত্রকর ও ভাস্করদের কাজের সমালোচনা। লন্ডনের দি নিউ এজ পত্রিকায়
হিউমের লেখাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। ফরাসি ও জার্মান ভাষায় দক্ষতার কারণে বার্গসঁ ছাড়াও
উইলহেম ভগনার-এর দর্শনের অনুবাদ করেছেন --'অ্যাবস্ট্রাকশন ও এমপ্যাথি', রেমি দ্য গুরমঁ'র -- 'শিল্পের অভিজাতীয় ধারণা', নিজস্ব ভাবনা --'সংবেদনশীলতা ও ভঙ্গী' -- ইত্যাদি লেখাগুলো নিউ
এজ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকলে সবার নজরে আসেন। এককথায় তাঁর দর্শন ছিল -- "প্রাকৃতিক
কারণেই মানুষ অপরিহার্যভাবে চিন্তায় সীমিত এবং অসাধারণ যে কোন কাজে অসমর্থ হয়ে থাকে।
সে কোনরকম পূর্ণতা অর্জনে অক্ষম কারণ, হয় প্রাকৃতিক অথবা ক্রমবিকাশের গাফিলতিতে সে নিজে নৈতিকতাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রবৃত্তির টানাপোড়েন
চলতে থাকে তার মধ্যে আর সর্বদা সেই দ্বন্দ্ব স্থায়ীভাবে তার চরিত্রে প্রতিফলিত হতে
থাকে।"
ইংল্যান্ডে ফিরে
এসে ১৯০৮ সালে কবিতা লেখা শুরু করেন হিউম। সেই বছরই লন্ডনের পোয়েটস ক্লাবের সেক্রেটারি
করা হয় তাঁকে। ক্লাবে একটি পেপার পড়েন তিনি
--'এ লেকচার অন মডার্ণ পোয়েট্রি'। উপস্থিত ছিলেন এজরা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট, এডমন্ড রোসে, ওয়াইন্ডহ্যাম লুইস, হেনরি নিউবোল্ট প্রমুখ।
সবাই প্রশংসা করেন তাঁর ভাবনার। পোয়েটস ক্লাবের বার্ষিক কবিতা সংকলনে সে বছর প্রকাশিত
হয় হিউমের কয়েকটি ইমেজিস্ট কবিতা যার মধ্যে শরৎ (অটাম) অন্যতম। পোয়েটস ক্লাবে আর নিউ এজ-এ প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধগুলির বিষয় ছিল
-- রোমান্টিকতা,
ইমেজ-ইমেজারি, ক্লাসিসিজম, নিউ মডার্নাইজেশন, কবিতার ছন্দ-সীমা, ক্লাসিকাল স্টাইল কেন
ভাঙ্গা উচিত, কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যাবহার, বস্তুবাচক দৃশ্যভাষা কি। কথায় কথায় তর্ক করার আর মারকুটে অভ্যাসটা
যায়নি তাঁর। এক মহিলাকেন্দ্রিক বচসায় লুইসকে এমন মার দেন যে, অপমানে জর্জড়িত লুইস
পায়ে ফাঁস লাগিয়ে উঁচু পথের রেলিং থেকে ঝুলে পড়েন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন দক্ষিণপন্থী
এবং 'শান্তিবাদ' শিরোনামে প্রবন্ধও লিখেছেন। সেই তিনি ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ গোলন্দাজ বাহিনীতে যোগ
দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চলে যান। তাঁর কবিতার সেখানেই ইতি। ৬ বছরের কবিতার জীবনে লিখেছেন
মোট ২৫টি কবিতা,
এবং সর্বসাকুল্যে মোট ২৬০ পংক্তি। তাহলে আমরা এখানে তাঁকে নিয়ে
আলোচনা করছি কেন ?
মৃত্যুর ৮ বছর পর
এজরা পাউন্ড হিউমের মাত্র পাঁচটি কবিতা নিয়ে নিজে এডিট করে একটি কাব্যপুস্তিকা, আজকাল যাকে চ্যাটবুক
বলা হয়, প্রকাশ করেন 'কমপ্লিট পোয়েটিকাল ওয়ার্ক অফ টি-ই-হিউম' নামে। তাঁর ভাবনা চিন্তাগুলি প্রকাশিত হত
কবিতায়। সমালোচক কারেন সেঙ্গারি এডিট করেন হিউমের প্রবন্ধগুলির সংকলনগ্রন্থ, অক্সফোর্ড প্রেস থেকে।
তিনি লেখেন -- বিংশ শতাব্দীর অক্ষর-দুনিয়ায় হিউমকে সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝা হয়েছে। ভীষণ
পলাতন প্রিয় ছিলেন তিনি। অথচ কীর্তির চেয়ে দীর্ঘ ছিল তাঁর প্রভাব। সেকথা অবশ্য এলিয়ট
এবং পাউন্ডকে পড়ে জানা যায়। হিউমের জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যর অব্যবহিত পরে সেই প্রভাবগুলি
স্পষ্ট ফুটতে দেখা যায়। ইমেজ, রোমান্টিক, নিউ মডার্ন -- কবিতায় এই সবের অভ্যাস লক্ষ্য করি আমরা। যুদ্ধে
গিয়ে কবিতা নয়, অন্যান্য লেখার বিরাম ছিল না তাঁর। 'স্পেকুলেশনস' শিরোনামে দুটি প্রবন্ধ
সংকলন টি-ই-হিউমের শ্রেষ্ঠ অবদান। এখানে পাউন্ডের এডিট করা পুস্তিকার কবিতাগুলি অনুবাদ করা
হল পাঠকদের জন্য।
হিউমের
হিউমার কবিতা
শরৎ
শীতশীতে শরতের
রাতে --
এই বাইরে বাইরে
হাঁটছিলাম
দেখি কি হেজের
গায়ে হেলান দেয়া লালটু চাঁদটা
ঠিক লালমুখো এক
যেন চাষা
কথা কইতে থামিনি
যদিও মাথাটাই নেড়েছিলাম;
তার চারপাশে কত
আশালীন চকে তারা
শাহরিক শিশুরা
যেমন
সাদায় সাদায় মুখর
ভুতুড়ে
অ্যাবোডা
হাজিরা দেবার
সময়টা বড় মধুর, উত্তেজনায় স্থির-কাঁপ,
আবেগের বাঁধে
উচ্ছ্বাস ভান
স্বভাবে
ফুরোয় না
অ্যাবোডার ভুতে
বঙ্কিম রূপে
ধনুষ পরিবৃত্তে
আকাশ সাজে
হরদম এক অজানা
দুঃখ শোকের মনে হয়।
তাতেও সেদিন বিলাপ
করতে শুনলাম --
" গোলাপেরা আর জোসেফেরা
এই ত্রুবাদুরে আমি ক্লান্ত
পরখিব সেই মহত্ত্ব
আছে কি নাই "
পরিবর্তন
তারপর তো খোশমেজাজে
বুনো উপত্যকাটায় ঢুকে পড়লাম
কালে কালে রঙ-রায়টের
লিলিতে,
যতদূর সুবাসী
বস্ত্রের মতো মোহিনী ছাইয়া মোরে
স্থাণু, দমফুরানু, সুন্দর তার
আপনাপনের প্রহরী।
এখন আমি সেই
পরম নদীর কাছাকাছি এসে পড়েছি
আলখাল্লায় মোড়া, কী কলঙ্ক, এক্কেবারে চুপিচুপি
ঠিক যেমনভাবে
বসফরাসে তুর্কী মারে উঁকি
গমনে গমন আমিও
ফেরিঘাটের
ওপরে
রাতদুপুরে শান্ত
ফেরিঘাটের ওপর
লম্বা মাস্তুলটার
মাথায় বাঁধা একটা চাঁদ
ঝুলছিল। এতদূর
থেকে মনে হচ্ছিল
খোকনের বেলুনটা
খেলার শেষে ভুলেছে
বাঁধ-নির্মাণ
(অসহ ঠান্ডা রাতে এক মুচড়ে পরা ভদ্রলোকের জন্য
গান)
একবার এক বেহালা
বাদকের বাহাদুরিতে আমার ভাবাবেশ হল
স্বর্ণ চরণ চমক
ফুটপাতে তাতে আমিই চমকাই।
এখন বুঝি আমি
যে উষ্ণতাই হল
কাব্যের আসল ব্যাপার
আকাশের তারা-খাওয়া
পুরনো কম্বলটাকে
ছোট করে দাও, হে ভগবান,
যেন আমি জড়িয়ে
নিয়ে শুয়ে থাকি আমাকে আরামে