বিজ্ঞানের প্রযুক্তিতে জাপানীরা সুবিদিত। শিল্পকলায়, যথা – অঙ্কনে, সিনেমায়, নাটকে, খেলাধুলা, সাহিত্যেও। কিন্তু আমরা, বাঙালিরা বিশ্বকবিতার ইতিহাস জেনে বসে থাকলেও জাপানী কবিতার
খোঁজ তেমন রেখেছি কি ? সঠিক অনুবাদ ও আগ্রহের অভাবে পড়ার তেমন ব্যবস্থা করা হয়নি। কেউ কেউ হাইকু সম্বন্ধে কিছু জেনেছেন বা অভ্যাস করেছেন নিশ্চয়ই। ‘বাক’-এর এই বিভাগে তাহলে আমরা, আসুন, কিছু জাপানী
কবিতার চর্চা করি।
ভারতে ইংরেজরা আসার আগে পর্যন্ত আমরাও তো
ধর্মকথা, দর্শন, ইতিহাস, রূপকথা, পুরাণপাঠ সব পদ্য বা শ্লোক দিয়ে রচনা করতাম। ইংরাজি শিক্ষার পর গদ্যরচনার প্রবর্তন হল। জাপানেও তেমনি উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ‘তাঁকা’ দিয়ে সেসব রচিত হত।
তাকে জাপানী ভাষার ছন্দোবদ্ধ শোলোক বলা চলে।
জাপানী ভাষায় শোলোক অনেকে মিলে উচ্চস্বরে গীত হলে তো মন্দিরের ঘন্টাধ্বনির মতো মনে
হয় আমার। ‘তাঁকা’ বা ওয়াকা পাঁচ লাইনের হয়ে থাকে। ৫,৭,৫,৭ এবং ৭ = মোট ৩১ সিলেবলে শেষ হয় তা। মধ্যযুগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত জাপানী সাহিত্যে এই ফর্মই প্রধান ছিল। সিরিয়াস পান, শব্দকেন্দ্র, আর ব্যাপকভাবে রূপকের ব্যবহার থাকতো। ‘তাঁকা’ তার পরেও অনেকে লিখে গেছেন, যেমন বাংলায় আজও কবিরা
মাইকেল বা জীবনানন্দকে অনুসরণ করেন। তবে সপ্তদশ
শতাব্দীতেই কিছু নতুনতর ফর্ম ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, যার মধ্যে প্রধান হল ‘রেঙ্গা’ বা লতানো পদ্য, যাতে তাঁকা’র তিনটে আর দুটো লাইনকে জুড়ে একটা দীর্ঘ পংক্তির
স্তবক তৈরি করা হত। ক্রমে এই রেঙ্গা থেকেই উদ্ভব হয় আরো ছোট ১৭
সিলেবল, তিন পংক্তির ‘হাইকু’ (হোক্কু বা হাইকাই)। সেটা আজও অনেকেই চালিয়ে গেলেও সর্বোচ্চ সম্মানের অসম্বাদিত অধিকারী হন ‘মাৎসুও বাশো’ (১৬৪৪ – ১৬৯৪)। একজন নগণ্য সামুরাই-এর সন্তান বাশো টোকিওতে
শিক্ষকতা করতে এসে কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং তার সময়েই তাঁকা থেকে রেঙ্গা হয়ে
হাইকুর স্টাইল গড়ে ওঠে।
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জাপান চীনা
সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্ত হয়ে পশ্চিমের সাহিত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইংরাজি ও অন্যান্য ভাষার বই অনুদিত হয়ে জাপানে আসে আর জাপানীরাও ছড়িয়ে পড়তে
থাকে বিশ্বে। তারই প্রভাবে জাপানে মুক্ত পদ্য (ফ্রি ভার্স)
রচনার প্রবর্তন হয় এবং আজ এই সময় পর্যন্ত সেটাই প্রবলভাবে চলে আসছে। আমরা এখানে বিংশ শতাব্দীর কবিতার কিছু উদাহরণ তুলে দিলাম বাক-এর পাঠকদের জন্য। জাপানী ভাষার ছন্দ টের পাওয়া মুশকিল, তাই যথাসম্ভব বাংলা লিরিক ফলো করা হল। এই রচনাটি উপস্থিত করেছেন বারীন ঘোষাল।
“তাঁকা” – ( কুনিও তাকায়াসু , ১৯১৩ )
১)
জলের উপরে সময় থাকে না স্থির
যেমন বা বোঝা যাবে –
শিশুদের, দুজন ওরা,
আমরা তো পিতা আর মাতা !
জলের উপরে সময় থাকে না স্থির
যেমন বা বোঝা যাবে –
শিশুদের, দুজন ওরা,
আমরা তো পিতা আর মাতা !
২)
জ্বলুনির মতো
বাতাস যার ভিতরে আমি
কাজ করছে আমার।
লাল পেন্সিলের ভিতরে
নরম হয়েছে শাঁস।
জ্বলুনির মতো
বাতাস যার ভিতরে আমি
কাজ করছে আমার।
লাল পেন্সিলের ভিতরে
নরম হয়েছে শাঁস।
( মিজুহো ওতা , ১৮৭৬ – ১৯৫৫ )
১)
যাজক একেলা
দিবানিদ্রা দিচ্ছেন --
ইভদের ওপাশের
মোহান্তের ঘরে
আকাশের সুনীল গভীরে।
যাজক একেলা
দিবানিদ্রা দিচ্ছেন --
ইভদের ওপাশের
মোহান্তের ঘরে
আকাশের সুনীল গভীরে।
২)
যেই ঝড়ের উপক্রম হল
দিনের বেলায়, নদীর বুকে
শিলার গায়ে অশান্ত হতবাক
কাকেরা কেন চেঁচায় সমানে।
দিনের বেলায়, নদীর বুকে
শিলার গায়ে অশান্ত হতবাক
কাকেরা কেন চেঁচায় সমানে।
“হাইকু” – ( দাকুৎসো ঈদা , ১৮৮৫ – ১৯৬২ )
১)
মৃত আগ্নেয়গিরির
শীতল তল – এবং
বনবুনো জামুন
মৃত আগ্নেয়গিরির
শীতল তল – এবং
বনবুনো জামুন
২)
এই এক সর্বনাশা রোগ
কী সুন্দর আমার হস্তনখর
কাঠকয়লাতে
এই এক সর্বনাশা রোগ
কী সুন্দর আমার হস্তনখর
কাঠকয়লাতে
( কুসাতাও নাকামুরা, ১৯০১ - )
১)
শরতে সাগর ভাসা
অন্তরীণে একটি
ব্যাপক উড়ানচাকি নীলে।
শরতে সাগর ভাসা
অন্তরীণে একটি
ব্যাপক উড়ানচাকি নীলে।
২)
শিশুর বাহনে
আপেল টলমলে
আঁকড়ে ধরে রাখে।
শিশুর বাহনে
আপেল টলমলে
আঁকড়ে ধরে রাখে।
৩)
তুষারপাত নাকি !
মেইজিদের কাল
বহুদূর চলে গেছে।
তুষারপাত নাকি !
মেইজিদের কাল
বহুদূর চলে গেছে।
৪)
হরিদাভা প্রসারিত
আর তার ভিতরে আমার
বাচ্চার দাঁত ফুটছে।
হরিদাভা প্রসারিত
আর তার ভিতরে আমার
বাচ্চার দাঁত ফুটছে।
( হাকিও ইশিদা , ১৯১৩ – ১৯৬৯ )
১)
অবাক ঈগল
নিঃসঙ্গতা কেন তার
ডানা ঝাপটায় --- ওহ্!
অবাক ঈগল
নিঃসঙ্গতা কেন তার
ডানা ঝাপটায় --- ওহ্!
২)
বাসের অপেক্ষায়,
বসন্তকাল দাঁড়িয়ে পথে
আছে নেই সন্দেহে।
বাসের অপেক্ষায়,
বসন্তকাল দাঁড়িয়ে পথে
আছে নেই সন্দেহে।
“মুক্তপদ্য” – ( রিউইচি তামুরা ১৯২৩ - )
হাজারো
দিনের রাত
একটি
অনন্য কবিতা জায়নের জন্য
তোমাকে আর আমাকে খুন করতে তো হবেই
নষ্ট করতে হবে আরও অনেক কিছু।
বহু প্রিয় জিনিষ, গুলি করে, ছুরি মেরে, বিষ দিয়ে।
তোমাকে আর আমাকে খুন করতে তো হবেই
নষ্ট করতে হবে আরও অনেক কিছু।
বহু প্রিয় জিনিষ, গুলি করে, ছুরি মেরে, বিষ দিয়ে।
দ্যাখো –
হাজার দিন আর রাতের আকাশ থেকে আমরা
ছোট্ট একটা পাখির থরথর জিহ্বা চেয়েছি বলেই
হাজারো নিশির নিরবতা আর হাজার দিনের বিপর আলোয়
আমি আর তুমি খুন গুলি।
শোন ----
বারিপতনের শহরগুলো, ধাতুগলনের চুল্লিরা,
গ্রীষ্মমাঝারে বন্দরে ও কয়লার খনি থেকে,
একটি শিশুর ক্ষুধিত অশ্রু চেয়েছি আমরা তাই নিয়ে
নিয়ে হাজারো দিনের প্রেম আর হাজার রাতের করুণা
তুমি তুমি আর আমি খুন করে ছুরিকায়।
বারিপতনের শহরগুলো, ধাতুগলনের চুল্লিরা,
গ্রীষ্মমাঝারে বন্দরে ও কয়লার খনি থেকে,
একটি শিশুর ক্ষুধিত অশ্রু চেয়েছি আমরা তাই নিয়ে
নিয়ে হাজারো দিনের প্রেম আর হাজার রাতের করুণা
তুমি তুমি আর আমি খুন করে ছুরিকায়।
মনে কর
---- নেড়ি কুকুরের ভয় চেয়েছি বলেই শুধুমাত্র
দেখতে পায় যা আমরা দেখি নাকো চোখ মেলে
শুনতে পায় যা আমরা শুনি না
হাজার রাতের আকাশকুসুম হাজার দিনের শীতের স্মৃতি
তুমি আর আমি বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছি।
দেখতে পায় যা আমরা দেখি নাকো চোখ মেলে
শুনতে পায় যা আমরা শুনি না
হাজার রাতের আকাশকুসুম হাজার দিনের শীতের স্মৃতি
তুমি আর আমি বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছি।
একটি একক
কবিতা আসবে বলে
তোমাকে আমাকে ভালবাসার জিনিষ খুন করতে হয়,
মৃতকে ফিরে দিতে প্রাণ এই মাত্র পথ রয়ে গেছে।
তুমি আর আমিও যাবো ওই পথে ।
তোমাকে আমাকে ভালবাসার জিনিষ খুন করতে হয়,
মৃতকে ফিরে দিতে প্রাণ এই মাত্র পথ রয়ে গেছে।
তুমি আর আমিও যাবো ওই পথে ।
(আৎসুহিরো সওয়াই, ১৯৪০ - )
একটি
আকস্মিক ছবি
গ্রামের
পথে এমনিই বেঁকে যেতে
বিচিত্র এক দৃশ্যের মুখোমুখি
অতীতের সেই মনের ছবির মতো
কোথাকার
কবেকার
স্থান আর কাল মনে নেই কোন
কোন ক্ষণে চেতনা পেরিয়ে যায় আমার ।
বিচিত্র এক দৃশ্যের মুখোমুখি
অতীতের সেই মনের ছবির মতো
কোথাকার
কবেকার
স্থান আর কাল মনে নেই কোন
কোন ক্ষণে চেতনা পেরিয়ে যায় আমার ।
এটা
অদ্ভুতভাবে পরিষ্কার যে
মনের সেই দৃশ্যটি,
যেটি এক অতল তলে জেগে উঠছে,
আমার ভিতরে প্রেরণা,
পাখির চোখের একটি লক্ষ্যবিন্দু হয়েও,
আমি যেন আর নেই সে আমি।
মনের সেই দৃশ্যটি,
যেটি এক অতল তলে জেগে উঠছে,
আমার ভিতরে প্রেরণা,
পাখির চোখের একটি লক্ষ্যবিন্দু হয়েও,
আমি যেন আর নেই সে আমি।