জলচুমকিরা ঢেউ ঢেউ
করছে
কবিতার অনুবাদ বিষয়ে আমার মতামত একটু বেয়াড়া।
প্রাথমিক অবস্থায় ভাষাহীন যে নিরাকার অনুভবের অনুবাদটি রচিত হয় কোন ভাষায়, পরবর্তী
কোন সময়ে অন্য কোন মেধায় সেই কবিতারই নতুন অনুভব স্পর্শ করলে সমসাময়িক উৎকর্ষে আবার
ভাষান্তরিত হতে পারে কবিতা। একটি কবিতার রচয়িতা ছাড়াও অনুদিত কবিতা অনুবাদকেরও হতে
বাধ্য। তাই তো কবিতার অনুবাদ চিরকাল এক থেকে অনেক হয়ে যায়। অধ্যাপকরা, পন্ডিতরা
অবশ্য এই মতবাদ অস্বীকার করবেন। আমার কিছু যায় আসে না।
বিপ্লবী কবি চেরাবান্দা
রাজু’র কবিতা নিয়ে বসেছি আজ। অমর শহীদ
বিপ্লবী কবি সুব্বারাও পাণিগ্রাহী ও সরোজকুমার দত্তের স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত
চেরাবান্দা রাজুর প্রথম ও একমাত্র কবিতার বই ‘ঢেউয়ে ঢেউয়ে তলোয়ার’ তার চল্লিশ বছর
বয়সে, যখন তিনি শেষ শয্যায়, তার চিকিৎসার স্বার্থে “বিপ্লবী লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবিদের
প্রস্তুতি সম্মেলনের আহ্বায়ক পরিষদ-পরিচালিত সংহতি প্রকাশনী” প্রকাশ করে ১৯৮১ সালে
পুজোর সময়। দাম ছিল সাড়ে তিন টাকা। বইটি আমি কিনেছিলাম সে বছরই। ফায়ারব্র্যান্ড
কবিতা তার, চিরকাল আন্দোলন আর জেল। মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট এই
সংগ্রামী কবির কবিতা অনুবাদ করেছেন মনিভূষণ ভট্টাচার্য (এই রাজনৈতিক শকুনের
বাচ্চাদের নবাবি চাল/পচাগলা ক্ষমতার যক্ষায় ঝরঝরে হয়ে গেছে--/যতদিন এদের নিকাশ করা
না যাচ্ছে/ ততদিন এরা শেষ হবে না।), শঙ্খ ঘোষ (বলতে শুনেছি ওদের/ যে, /অজ
পাড়াগায়েঁ পৌঁছল লাল গানের ছন্দমিল/ আরো লাল হয়ে উঠছে রক্ত ভুখা এ মানুষদের /গ্রামে
গ্রামান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে শিখা।/এই আমাদের গ্রাম/তবে কি
মত্ত বিপ্লবে উঠে দুলে?/আর/মা তবে দিয়েছে কি আজ/যুদ্ধপতাকা তুলে?), বিপ্লব
চক্রবর্তী (কামারশালায় লেগেছে আগুন/ প্রতিটি হাপর ফুঁসছে/আগুনে আগুন জ্বালো, সাথী,
জ্বালো/ প্রতীক্ষা ক’রে থেকো না কখন/ভোরের সূর্য উঠছে।) ---- ইত্যাদি অনুবাদের
টিউনিং দেখে মনে হচ্ছে না -- বিপ্লবী কবির বিপ্লবী ইমেজটি ধরে রাখার সমবেত চেষ্টা
হয়েছিল? আমি অন্যরকম ভাবি। একজন কবি আগে কবি, তারপর সে বিপ্লবী। অন্য সময়ে দাঁড়িয়ে
আমি চেরাবান্দা’র মূল অনুভুতির কাছে গিয়ে আবার শুরু করতে চাইলাম। ভাল লাগল আমার। অনুবাদে
যাবার আগে একবার চট করে চেরাবান্দার মাত্র চল্লিশ বছরের জীবনীটা বেড়িয়ে আসি চলো।
হায়দ্রাবাদ থেকে তিরিশ মাইল দূরে অঙ্কুশপুরম গ্রামের এক দরিদ্র চাষী
পরিবারে ১৯৪২ সালে জন্মেছিলেন বি, ভাস্কর রেড্ডি, যিনি কালক্রমে তার লেখক ছদ্মনাম
গ্রহণ করেন, “চেরাবান্দা রাজু”। হায়দ্রাবাদের কলেজে তেলেগু ভাষায় অধ্যয়ন করতে গিয়ে
কবিতায় হাতেখড়ি হয় তার সাবেকী রীতিতে। আলাপ হল বিখ্যাত কবি
নিখিলেশ্বরের সংগে। ক্রমশ নিখিলেশ্বরের সম্পাদনায় ১৯৬৫ সাল থেকে প্রকাশিত
‘দিগম্বর’ গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত হন। জগৎ আর জীবন সম্পর্কে বিরক্তি আর হতাশা এদের
কবিতায় ভাষা পেয়েছিল। ভাবনা চিন্তায় এরা মার্কিন ‘বিট’ আর ইংল্যান্ডের ‘অ্যাংগ্রি ইয়ং মেন’-দের সগোত্র। সমাজের প্রতি এক রাগী
প্রতিবাদ তাদের কবিতায় নৈরাজ্যবাদ, বিলোপবাদ, নব-বাম চিন্তাচেতনা, আবেগ, তাড়না,
জন্মসংস্কার, এবং অবচেতনের উদ্দামতা ভাষা পেতো। কিন্তু পর্বান্তর হল অচিরেই। নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিকায় নবজাগরণ ঘটল
অন্ধ্রের লেখক শিল্পীদের। এই জাগরণের সংহত রূপ --অন্ধ্রের বিপ্লবী লেখক সংঘ বা
‘বিপ্লব রচয়িতাল সংঘম্’-এর সংগঠন। সংক্ষিপ্ত নাম “বিরসম্”। ১৯৭০ সালের জুলাই
মাসে ‘বিরসম্’-এর প্রতিষ্ঠা। অন্ধ্রের অধিকাংশ শক্তিশালী লেখক এই সংগঠনের সঙ্গে
যুক্ত হয়ে পড়েন। চেরাবান্দাও তাদের একজন। ‘বিরসম্’-এর দায় বহন করতে গিয়ে তিনি
নিজে আমূল পরিবর্তিত হয়েছেন ভাবনা চিন্তায় এবং লেখনীতে। ফলে চেরাবান্দা যেখান থেকে
শুরু করেছিলেন তার কবিজীবন, সেই দিগম্বর গোষ্ঠির কবি হিসেবে তার পরিচয় অচিরেই মুছে
গেছে, সবচেয়ে জনপ্রিয় বিপ্লবী কবিতার সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠেছে তার নাম। নকশালবাড়ি
আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে সব তেলেগু লেখকদের আবির্ভাব, চেরাবান্দা রাজু সম্ভবত তাদের
মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
কবিতা-গান ছাড়াও চেরাবান্দা লিখেছিলেন একটি উপন্যাস (মা ভুরু – আমাদের
গ্রাম), তিনটি একাঙ্ক (গঞ্জ, নীল্লুগুরুয়াল, ফেলে রাখা ফাইল)। তিনি ছিলেন একজন
দায়বদ্ধ কবি, এবং সুনিশ্চিত পক্ষ অবলম্বনের ফলে পরবর্তী দশ বছর তাকে শান্তিতে
থাকতে দেয়নি রাষ্ট্র। হাজতবাস, কারাবাস, মামলা, দৌড় লেগেই থাকত। ক্রমে স্কুলের
চাকরিটি খোয়ান, স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। মাথায় দুটি টিউমার অপারেশন করা হয়। শেষ
পর্যন্ত বন্ধুরা একটি কবিতার বই ছেপে বিক্রিত অর্থে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল।
আমি সেই বইটি ওলটাচ্ছি এখন। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়
হায়দ্রাবাদে। এখন সেই জুলাই মাস। আমেন। তার কবিতার মৎকৃত অনুবাদ কেমন লাগে দেখ।
চোখে মেঘে ঝাপসা আকাশ
প্রজন্ম
কবেকার চোখের পানি
ভু ভু করা দূরের কথা দুর্দুর
যদি খাল কেটে আনা হতো স্রোত
তাতে হৃদয় ফিদয়
লহরিয়া মর্মরণে ঘুরতেই থাকে ঘুর্ণী।
এটা একটা প্র-পরা প্রান্তর
আসল গাঁয়ের দূরে
একটা সরোবর ঝাঁপিয়ে পড়ে আকাশটাকে ধরল
কি কি যে ঝাপসা হওয়া সাজে না
রাখালটির খালটির এত স্রোত কেন
দু-পা মচকানো শব্দ বইছে সে।
কিছুটা মায়ের কিছু নামায়ের ডাক ডাকছে
হাসি কান্নার সিনে বাছুর ঢুকেছে ঢুঁসোতে
একটা লম্বা বাজ
একটু বিদ্যুৎলতা
সবে তো বাছুর
গর্তটা খুলে গেল।
এপার ওপার আকাশের সবটাই হসন্তে
ঝলকে উঠল মুক্ত কাস্তেরা
গাঁয়ের যেখানে গ্রাম
সরে থাকে সরোবর
বাঁধ ভাঙলে জল থাকে না জলে।
একটাই হৃদয়
তাতে একাকিষাণ
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একাকী হচ্ছে তার জীর্ণ কুঁড়েটি
দেয়াল ভাঙলে যা হয়
চাল ভাঙলে
খড়কুটোয় হাওয়া নাকি বাতাস দিলে কী যে উড়বিয়ান।
রাখালের বউকে যেন কি বলে
তার ঘরহীন ঘরহীন করা অবাক ছেলেকে
প্রতিবেশীর চালের তলায় এভাবে
কবিতাকে সরিয়ে বসে ভগবান।
পাতায় পড়ছে গড়িয়ে পড়ছে আবার
টাপুর টুপ শোনার কানে কান্না
গাছে গাছে শাখায় শাখায় একটাই ধ্বনি ডাকে
বন্যা অবন্যা আর কিষাণ লড়াই করে দাঁড়িয়ে।
ভাবনার গড্ডলগুলি দেখবে কি করে
মেঘবাতাসের গর্জন
মাকড়সার জালি মেঘ
কোন সম্পর্ক নেই
শেষের পর্দা কেউ টানল না
ছাঁটের পরের আরো ছাঁট যেন এই ভরে ওঠা।
এই তো সময় মদ আর মাংসের
এ শুধু নেশার দিন যে ভাবে
রাখালটা হারিয়ে যাচ্ছে স্রোতে
বউ বাচ্চার কথা তার মনে পড়বে কিনা আমি জানি না।
জলের পাড় নেই আকাশের পাড়
নেই, দৃশ্য নেই কোন
স্মৃতিরেখা চাপানো পললে
ঢেউ উঠে উঠে যে অচেনা হয়েছে
জীবনের নয়
ঢেউয়ের নয়
নিজেই নিজের ঢেউ হয়েছে আজ জলে।
চোখে মেঘ আর ঝাপসা আকাশ
পরস্পরকে দেখছে থরথর।
(এই বিভাগটি
সাজিয়েছেন বারীন ঘোষাল।)